ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা জানার জন্য আজকের আর্টিকেলটি পুরোপুরি পড়ুন। লাল চাল খাওয়ার প্রচলন আমাদের দেশে অনেক বছর আগে থেকেই চালু থাকলেও এখন অনেকেই খেতে চাইনা। আমরা অনেকেই ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল সম্পর্কে জানিনা।
ধান থেকে খোসা ছাড়ানোর পরেই লাল চাল বের হয়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে একটা চালের তিনটি অংশ থাকে, যার উপরের অংশকে বলে তুষ বা খোসা, তারপরে লাল অংশ বা ফাইবার ও ভেতরের অংশকে বলে বীজ বা দানা।
পেজ সুচিপত্র
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল কি বা কাকে বলে
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানার আগে আমাদের প্রথমেই জানা দরকার লাল চাল কি বা কাকে বলে? কলের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকিতে চাল ছাঁটাই করে বা পাড় দিয়ে বা প্রক্রিয়াকরণ করা হতো।
বাড়িতে, ধান ঢেঁকির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের সময় ধানের খোসা বা তুষ ফেলে দেওয়ার পরে লাল যে অংশ থাকে তাকে লাল চাল বলে। ধানের খোসা ছাড়ানোর পরে চালের উপরে এক ধরনের লালচে প্রলেপ পাওয়া যায়, এই লালচে প্রলেপ সমেতো চালকে লাল চাল বলে।
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাউলগুলোর তুষ বা কুড়া ফেলে দেওয়ার পরে লাল রং বিশিষ্ট্য হয়ে থাকে। এই লাল রঙের চালকে ঢেঁকি ছাঁটা লাল বলা হয়। এই লাল চাল কুড়াকাটা চাল বা ব্রাউন রাইচ নামেও পরিচিত। লাল অংশের কারণে লাল চালের পুষ্টিমান বেশি হয় থাকে। লাল অংশ কলে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয় যার কারনে সাদা চালে পুষ্টিমান কম থাকে।
লাল চালের নাম
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা শিরোনাম আলোচনায় আমাদের জানা দরকার ঢেঁকি ছাঁটা লাল চালের নামগুলো সম্পর্কে। সাধারণতঃ ধানের নাম অনুসারে চালের নামকরণ করা হয়ে থাকে। লাল চালের ধানের বিভিন্ন জাত আছে,
আরো পড়ুনঃ ডুমুরের পুষ্টিগুণ ও খাওয়ার উপকারিতা
যেমন - আমন ধান থেকে আমন চাল, আঊশ ধান থেকে আঊশ চাল, মুক্তাহার ধান থেকে মুক্তাহার চাল, রাজমণ্ডল ধান থেকে রাজমণ্ডল চাল, শনির ধান থেকে শনির চাল, হিদার ধান থেকে হিদার চাল ইত্যাদি। সবগুলো লাল চাল।
লাল চালের পুষ্টিগুণ
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা শিরোনাম আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করবো লাল চালের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে লাল চালের পুষ্টিগুণ সাদা চালের পুষ্টিগুণের চেয়ে অনেক বেশী। এই লাল চালে রয়েছে
পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, রিবোফ্লেভিন ও আয়রণসহ অন্যান্য ভিটামিন যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লাল চালে প্রাপ্ত পুষ্টি মানের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো।
আরো পড়ুনঃ মধুর পুষ্টিগুণ খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
প্রতি ১৯৫ গ্রাম লাল চালের ভাতে নিম্নরূপ পুষ্টিমান পাওয়া যায়
- পুষ্টি উপাদানের নাম - পুষ্টিমান
- স্নেহ বা ফ্যাট - ১.৬ গ্রাম
- আঁশ বা ফাইবার - ৩.১২ গ্রাম
- ক্যালরি - ২.৩৮ গ্রাম
- সুগার - ০.৪৬৮ গ্রাম
- প্রোটিন - ৫.৩২ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট - ৪৯.৫ গ্রাম
- থিয়ামিন - ০.৬ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি২ - ০.১৪ মিলিগ্রাম
- নিয়াসিন - ৫ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৫ - ১.৩ মিলিগ্রাম
- আয়রণ - ৪.৭ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম - ১৩৩ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম - ৬.৫ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন ই - ২ মিলিগ্রাম
- সেলেনিয়াম - ৭৮ মাইক্রগ্রাম
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চালের উপকারিতা
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করবো লাল চালের উপকারিতা সম্পর্কে। পূর্ণশস্য খ্যাত লাল চালে অধিক পরিমাণে খনিজ, মিনারেলস ও আঁশ বা ফাইবার থাকে শরিরের জন্য অনেক উপকারি।
পূর্ণশস্য হওয়ায় অন্যান্য কলে ছাঁটা চালের তুলনায় লাল চালের পুষ্টিমানও বেশি থাকে। বহুবিধ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল মানব দেহের নানা রকমের উপকার করে থাকে। এই উপকারিতা পর্যায়ক্রমে নিম্নে আলোচনা করা হলো।লাল চাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
নানাবিধ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লাল চালে রয়েছে বিভিন্ন রকমের রোগ প্রতিরোধী খাদ্য উপাদান। লাল চালে বিদ্যমান এন্ট্রিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
আরো পড়ুনঃ লটকন ফল খাওয়ার ১০ টি উপকারিতা
লাল চালে রয়েছে ফ্লাভোনয়েড নামক এক ধরনের জৈব পদার্থ যা শরীরের রোগ প্রতিরধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও লাল চাল পাকস্থলির ক্যান্সার, অগ্নাশয় ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সার রোধ করতে সহয়াতা করে।
ডায়াবেটিস বা সুগার নিয়ন্ত্রণে লাল চালের উপকারিতা
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করবো ডায়াবেটিস বা সুগার নিয়ন্ত্রণে লাল চালের উপকারিতা সম্পর্কে। ডায়াবেটিস বা রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে সেই মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্বোহাইড্রেট বেশি ভূমিকা পালন করে।
কলে ছাঁটা চালের তুলনায় ঢেঁকি ছাঁটা লাল চালে বেশি পরিমাণে ফাইবার ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স লাল চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এর তুলনায় অনেক কম।
আরো পড়ুনঃ অর্থসহ মেয়ে বাচ্চাদের ইসলামিক নামের তালিকা ও ইংরেজী বানান
লাল চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি হওয়ার কারণে খুব ধীরগতিতে হজম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সে কারণে রক্তে সুগারের মাত্রা কম বাড়ে, এজন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকে।
ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল বা পূর্ণ শস্যে লাল অংশ থাকার কারণে এটা স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট উপকারী। পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে লাল চাল কলে ছাঁটা সাদা চালের তুলনায় হৃদরোগের ঝুঁকি ১৬ থেকে ২১ শতাংশ কমায়।বলা যেতে পারে যারা সাদা চাউল খান
তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি ১৬ থেকে ২১ শতাংশ বেশি থাকে লাল চালের তুলনায়। ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল রক্তের ব্যাড কলেস্ট্ররল বা এল ডি এল কমায় এবং গুড কোলেস্টেরল বা এইচ ডি এল বাড়ায় ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ থাকে।
দাঁত ও হাড়ের গঠনে লাল চালের উপকারিতা
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করবো দাঁত ও হাড় গঠনে লাল চালের উপকারিতা সম্পর্ক। ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ লাল চাল হাড়ের ভিতরের অস্থিমজ্জার ঘনত্ব বাড়ায়।
আরো পড়ুনঃ অর্থসহ ছেলে বাচ্চাদের ইসলামিক নামের তালিকা
লাল চালে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠন শক্ত ও মজবুত করে। ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ লাল চাল খেতে যেমন সুস্বাদু হয় তেমনি জয়েন্টের ব্যথা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
ত্বক ও চুলের যত্নে চাল ধোয়া পানির উপকারিতা
বর্তমান সময়ে বড় একটা সমস্যা হল চুল পড়ে যাওয়া বা ঝরে যাওয়া। তাই চুলের যত্নে লাল চালের দ্বিতীয় ধোয়ার পানির সাথে মেথির গুড়া ও মৌরি একসাথে মিশিয়ে মাথায় ব্যবহার করলে খুশকি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ও চুল ঝরে পড়া কমে যায়। কোন কিছু না মিশিয়ে লাল চালের দ্বিতীয় ধোয়ার পানি দিয়ে নিয়মিত মুখমণ্ডল পরিষ্কার করলে ত্বক উজ্জ্বল, মসৃণ ও সুন্দর হয়।
ওজন কমাতে লাল চালের উপকারিতা
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করবো লাল চালের ভাত খেলে ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে। এই চালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ থাকে যা খেলে অনেক সময় ধরে পেট ভরা ভরা থাকে। এতে করে নতুন করে খাবারের প্রবণতা কম থাকে। ফলে ওজন কমতে সহয়তা করে।
ক্ষতিকর গ্লটেন মুক্ত ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল
গ্লটেন হলো এক ধরনের প্রোটিন যা বিভিন্ন শস্য দানাতে পাওয়া যায়। এই গ্লটেন স্বাস্থ্যের জন্য অনেকটাই ক্ষতিকর। এই প্রোটিনগুলোতে অ্যালার্জি থাকার কারণে অনেকেরই পেট ব্যথা, ডায়রিয়া বা ত্বকে ফুসকড়ি হতে পারে।
লাল চাল এই ক্ষতিকর গ্লটেন মুক্ত। এই ক্ষতিকর গ্লটেনযুক্ত খাদ্য পরিহার করা সবার জন্যই ভালো। বিশেষ করে হার্টের রোগী ও ডায়াবেটিস রোগীরা গ্লটেন মুক্ত লাল চালের ভাত খেলে উপকৃত হন।
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল কোথায় পাওয়া যায়
আগের দিনে আমাদের দেশের প্রায় সব বাড়িতে বাড়িতে লাল চাল পাওয়া যেত। বর্তমানে এ চাল পাওয়া খুব বিরল। ঢেঁকির প্রচলন কমে যাওয়ায় বর্তমানে রাজশাহী, নোয়াখালী, ময়মনশিংহ, সিলেট, গোপালগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও দিনাজপুরের কিছু অঞ্চলে লাল চাল পাওয়া যায। শহরের সুপার সপগুলোতে ও বড় বড় চালের দোকানগুলোতে লাল চান পাওয়া যায়।
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চালের দাম কত
ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা আলোচনায় এখন আমরা জেনে নেব ঢেঁকি ছাঁটা লাল চলের দাম কত? বর্তমান সময়ে ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল পাওয়াই বিরল। এ চালের দাম যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়।
শহরের দোকানগুলোতে ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। গ্রামের কিছু কিছু দোকানেও চাল পাওয়া যায়। গ্রামের দোকানগুলোতে দাম একটু কম অর্থাৎ প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
লেখকের মতামত
বাঙ্গালি তথা আমাদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। এই ভাত হতে হবে নিরাপদ, ভিটামিনযুক্ত ও অধিক পুষ্টিমান সম্পন্ন। তাই লাল চালের গুরুত্ব অনেক বেশি। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে যন্ত্র বা কলে ছাঁটা চাল চিকন ও দেখতে সুন্দর হলেও পুষ্টিমান কম প্রখান্তরে লাল চালের ভাত খেতে সুস্বাদু ও অধিক পুষ্টিকর।
ঢেঁকি ছাটা লাল চাল সম্পর্কে আজকের আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা লাল চাল সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছেন ও উপকৃত হয়েছেন। নির্ভেজাল ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল অধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ তাই এ লাল চালের ভাত সকলের খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। সবাইকে ধন্যবাদ।
aksgreenit নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url