হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে আজকে আমরা আলোচনা করব। হাতিশুড় গাছ কম বেশি সবার কাছেই পরিচিত,তবে শহরের চাইতে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কাছেই বেশি পরিচিত। এই গাছের পাতা শিকড়ের ঔষধি গুনগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে। মনোমুগ্ধকর ঔষধি গুনগুলো জানার জন্য আজকের এই আর্টিকেলটি পুরোপুরি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
প্রাচীনকাল থেকেই হাতিশুড় গাছগুলোর অস্তিত্ব লক্ষণীয়।এই গাছগুলো ঔষধি গুনাগুণের জন্য চরক সংহিতাসহ অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে এর সম্পর্কে আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ইউনানী ও কবিরাজি শাস্ত্রে এই গাছটির যথেষ্ট কদর রয়েছে।এই গাছগুলো মুলত এশিয়া মহাদেশেই পাওয়া যায়। এই হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়মগুলো পর্যায়ক্রমে নিম্নের আলোচনায় জানবো।
পেজ সুচিপত্র
হাতিশুড় গাছের পরিচিতি
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম আলোচনার আগে আমাদের জানা দরকার হাতিশুর গাছের পরিচিতি সম্পর্কে। গাছের নাম হাতিশুড়! নামটা শুনলেই কেমন একটু অন্যরকম মনে হয়। মনের মধ্যে যেরকমই হোক না কেন গাছটার নাম কিন্তু হাতিশুড়।
এই গাছের পুস্পদন্ড হাতির শুঁড়ের মত একটু বাঁকানো। পুষ্পদন্ডের নাম অনুসারে এই গাছটির নামকরণ করা হয়েছে হাতিশুড়। এই পুষ্পদন্ডের উপরে হস্তিদন্তের মত সাদা ফুটফুটে ফুল ফুটে থাকে।কোন কোন সময় বেগুনি রঙের ফুলও দেখা যায়।
এই ফুলগুলোতে একটি করে পাপড়ি থাকে, তাতে পাঁচটি খাঁজ কাঁটা থাকে। সারা বছরই এই উদ্ভিদের ফুল ফুটে তবে বর্ষাকালেই বেশি ফুল ফুটতে দেখা যায়। কোন কোন সময় ফুলগুলো দেখতে মাইকের মত লাগে। এ গাছের ফল ও বীজগুলো ছোট ছোট হয়।
আরো পড়ুন: শিমুলের মূল খাওয়ার উপকারিতা কি
এই গাছগুলো সাধারণত দেড় থেকে দুই ফিট লম্বা হয়।গাছের কান্ড ফাঁপা ও নরম হয়ে থাকে।কাণ্ড জুড়ে ছোট ছোট রোম থাকে। গাছের উপরের দিকের কান্ডগুলো চিকন বা চৌকা হয় আর নিচের দিকের কান্ডগুলো গোলাকার, মোটা ও ফাপালো হয়। এই গাছের ডালের নিচের দিকের পাতাগুলো অপেক্ষাকৃত বড় ও পত্রবৃন্ত লম্বা হয়।
বড় বড় পাতাগুলো দেখতে অনেক সময় বর্শার ফলার মত লাগে। পাতাগুলো দেখতে খসখসে। একটি পাতার বিপরীতে অন্য একটি পাতার অবস্থান। পাতাগুলো ঘোষলে এক ধরনের গন্ধ পাওয়া যায়। ইনডিসিন, পাইরোলিজিডিন এলকালয়েডস ও হেলিওটিন নামক নানারকম জৈব উপাদান এই উদ্ভিদে পাওয়া যায়। এর শিকড় আছে এসট্রাডিওল নামক জৈব উপাদান।
আরো পড়ুনঃ নিমপাতা ব্যবহারের উপকারিতা গুলো কি কি?
হাতিশুড় গাছটি একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Heliotropium indicum ( হেলিওট্রপিয়াম ইন্ডিকাম ) ও ইংরেজিতে বলা হয় ' Indian Heliotrope ' ( ইন্ডিয়ান হেলিওট্রোপি )। এই উদ্ভিদটি অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই উদ্ভিদকে সংস্কৃত ভাষায় শ্রীহস্তিনী বলা হয়। এছাড়াও হাতিশুড় গাছের আঞ্চলিক আরো অনেক নাম রয়েছে যেমন হাতিশুড়ো, হাতিশুড়ি, হাতিশুন্ডি, হস্তিশুন্ডি, মহাশুন্ডি, শ্রীহস্তিনী ইত্যাদি।
কেমন জায়গায় হাতিশুড় গাছ জন্মায় বা পাওয়া যায়
হাতিশুড় গাছের পাতা-শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানতে হবে এই গাছগুলো কোথায় পাওয়া যায় বা কোথায় জন্মায়? হাতিশুড় গাছগুলো অন্যান্য আগাছার মতোই যেখানে সেখানে যতছত্র ভাবে জন্মায়।বিশেষ করে পুরনো দেয়াল বা দালাল-কোঠার গাঁ ঘেঁষে কিংবা রাস্তার ধারে একটু জায়গায় জংগলে বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে অন্যান্য আগাছার সাথে অযত্নে এই গাছগুলো বেড়ে উঠতে দেখা যায়।
আরো পড়ুন: ভিটামিন ই ক্যাপসুল মুখে ব্যবহারের নিয়ম
এই গাছটি অনেক ঔষধি গুনসম্পন্ন তাই সকলেরই চেনা থাকা দরকার। সারা বছরই এ গাছগুলো পাওয়া গেলেও বর্ষা মৌসুমে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রত্যেকটি থানা পর্যায়ে সরকারি বন বিভাগ কর্তৃক বনায়ন কার্যক্রম সফল করার উদ্দেশ্যে সরকারি নার্সারি থেকে জনসাধারণের মাঝে সুলভ মূল্যে এই ধরনের ঔষধি প্রজাতির চারা গুলো বিতরণ করা হয়ে থাকে। আপনি এই নার্সারীগুলো থেকেও হাতিশুড় গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারবেন।
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা সম্পর্কে এখন আমরা আলোচনা করব। বহু গুনে গুণান্বিত এই হাতিশুড় গাছের পাতা ও শিকড় মানব শরীরে বিভিন্নভাবে উপকার করে থাকে।
এই হাতিশুড় গাছের পাতা বা শিকড়ে রয়েছে নানাবিধ জৈব উপাদান, এই উপাদানগুলোর নাম আমরা উপরের আলোচনায় পড়েছি। এই উপাদান গুলোই আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ প্রতিরোধ করে শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। হাতিশুড় গাছের পাতা ও শিকড়ের উপকারিতা গুলো নিম্নরূপ।
কাশি ও জ্বর নিরাময় করে
হাতিশুড় গাছের পাতা ও শিকড়ে রয়েছে জ্বর ও কাশি নিরাময়ের জৈব উপাদান। এই গাছের মূল পানির সাথে মিশিয়ে ফুটিয়ে নির্যাস তৈরি করে উষ্ণ উষ্ণ গরম থাকা অবস্থায় খেলে জ্বর ও কাশি থেকে নিরাময় পাওয়া যায়।
সর্দিতে উপকার করে
আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে যাদের ঘনঘন সর্দি লাগে তারা যদি হাতিশুড়ের পাতা সেচে দু চামচ পরিমাণে রস খান তাহলে সর্দি থেকে উপশম পাবেন।
আরো পড়ুন: মহররমের তাৎপর্য ও আশুরার মহাত্ম্য এবং ১০ মোহররমের ২০ ঘটনা
এছাড়াও হাতিশুড় পাতার রস অল্প গরম জলে মিশিয়ে গার্গিল বা গড়গড়া বা কুলকুচি করলে ফ্যারেনজাইটিস রোগে উপশম পাওয়া যায়।
হাতিশুড়ের শিকড় যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে
হাতিশুড় গাছের শিকড় যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে। যদি কেউ হাতি শুঁড় গাছের মূল বা শিকড় মধুর সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে ও রাতে ঘুমানোর আগে নিয়মিত একটানা ২১ দিন খায় তাহলে তার যৌন শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
শরীরের ফোলা ও ব্যথা কমায়
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুলে গেলে বা ঠান্ডা জনিত কারণে হাত-পা এর গিঁট ফুলে গেলে অথবা তলপেটের মাঝখানে ও কুচকির বাম দিকে বা ডান ফুলে গেলে এই হাতিশুড়ের গাছের পাতা বেটে হালকা গরম করে আক্রান্ত জায়গায় লাগালে ফোলা ও ব্যথা কমে যায়।
ছত্রাক নিরাময় করে
দেহে ছত্রাক জনিত সংক্রমনে লাল চাকা চাকা দাগ নিরাময়ের জন্য এই পাতা বেটে রস ওই লাল চাকার উপর লাগালে ছত্রাক থেকে উপশম পাওয়া যায়।
বিষাক্ত পোকার কামড়ে স্বস্তি
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম এ এখন জানুন বিষাক্ত পোকার এর উপকারিতা সম্পর্কে। বিষাক্ত পোকা কামড়ালে অনেক জ্বালাপোড়া করে, এই জ্বালাপোড়ার জায়গায় হাতিশুড় গাছের পাতার রস লাগালে জ্বালা পোড়া ও ফোলা কমে যায়।
দাঁত ও মাড়ির ফোলা কমায়
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম অত্যন্ত চমৎকার। কিছু কিছু লোক আছে যাদের দাঁতের মাড়ি ফুলে যায়। যাদের দাঁতে মাড়ি ফুলে তারা নিয়মিত হাতিশুড় গাছের মূল চিবালে এই ফোলা কমে যায়।
চোখ পরিষ্কার করে
কোন কারনে চোখ টকটকে লাল হলে বা খচখচ করলে বা মনে হচ্ছে কিছু একটা পড়েছে এমন হলে হাতিশুড় গাছের পাতার রস উপকারে আসতে পারে
আরো পড়ুন: কানের দুলের রকমারি ডিজাইন ছবি ২০২৪
ছোটবেলায় বাপ চাচাদের দেখেছি গরু-ছাগলের চোখে পানি আসলে বা ইনফেকশন হলে হাতিশুড় পাতার রস করে চোখে দিলে চোখ ভালো হয়ে যেত।
ক্ষতস্থান নিরাময় করে
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম আলোচনায় এখন জানবো ক্ষতস্থান সারাতে হাতিশুড়ের উপকারিতা। শরীরের কোন জায়গায় কেটে গেলে বা ক্ষত হলে হাতিশুড় পাতা থেতলে রস নিয়মিত লাগালে কাটা, ছেঁড়া, ক্ষত ও ব্যথা ভালো হয়ে যায়।
মুখের ত্বক বা ব্রণ এর জন্য উপকারী
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে এখানে জেনে নিন ত্বকের যত্নে এর উপকারিতা কি। মুখের ব্রণ হলে বা দাগ হয়ে গেলে হাতিশুড় গাছের পাতা বা কচি ডাল বেটে দুপুরে গোসলের এক ঘন্টা আগে আলতোভাবে লাগিয়ে রেখে পরে ধুয়ে ফেললে ব্রণ ভালো হয় এবং মুখের ত্বক সুন্দর হয়।
একজিমা দূর করে
হাতিশুড় গাছের পাতা একজিমা থেকে মুক্তি দিতে পারে যাদের শরীরে দীর্ঘদিন ধরে একজিমা রোগ আছে বা ভালো হয় না তারা যদি হাতিশুড় গাছের পাতা বেটে নিয়মিত কয়দিন ব্যবহার করেন তাহলে একজিমা সেরে যাবে।
টাইফয়েড জ্বর উপশম করে
হাতিশুড় পাতার রস টাইফয়েড জ্বরের কার্যকরী সমাধান হতে পারে। যদি কারো টাইফয়েড জ্বর হয় তাহলে এই হাতিশুড় গাছের পাতার রস হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে নিয়মিত কয়েকদিন খেলে টাইফয়েড জ্বর ভালো হয়।
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড় খাওয়ার নিয়ম
অনেক ঔষধি গুণসম্পন্ন এই হাতিশুড় গাছের পাতা ও শিকড়ের উপকারিতা সম্পর্কে উপরের আলোচনায় জানতে পেরেছি। এখন আমরা জানবো হাতীশুড় গাছের পাতা ও শিকড় খাওয়ার নিয়ম। যারা আর্টিকেলটি পুরোপুরি পড়েছেন তারা খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে অনেকটাই অবগত হয়েছেন।
হাতিশুড় গাছের পাতা কখনো কখনো বা কোন কোন রোগে পিষে রস খেতে হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে পিসে ক্ষতস্থানে লাগাতে হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে এর শিকড় চিবিয়ে খেতে হয়। কোন কোন রোগ সারানোর জন্য কুসুম গরম পানিতে পাতা সিদ্ধ করে গড়গড়া করতে হয়। কোন কোন রোগের ক্ষেত্রে পাতার রস কুসুম গরম জলের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়।
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড় খাওয়ার সতর্কতা
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম আলোচনায় এখন আমরা আলোচনা করব হাতিশুড় গাছের পাতা ও শিকড় খাওয়ার সর্তকতা সম্পর্ক। হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উল্লেখযোগ্য কোন অপকারিতা নেই।
বহু ওষুধি গুণে গুণান্বিত হাতিশুড়ের উপকারীতাই বেশি। তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। উপকারি বলেই বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করে খাওয়া উচিত।
- গর্ভবতী মায়েদের খাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- হাতিশুড়ের পাতা - শিকড় খেলে অনেকেরই এলার্জি দেখা দিতে পারে। যদি অ্যালার্জি দেখা দেয় তাহলে খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
- হাতিশুড়ের পাতা - শিকড় বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত না, এতে ক্ষতি হতে পারে।
পরিশেষ
হাতিশুড় গাছের পাতা শিকড়ের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে আপনারা সবাই আজকের আর্টিকেল পড়ে অবগত হয়েছেন। এই গাছটি অত্যন্ত ঔষধিগুণ সম্পন্ন যা হয়তো আমরা আগেও জানতাম আর আজকে আরো বিশদভাবে জানতে পারলাম। সঠিক নিয়ম মেনে এই গাছের পাতা - শিকড় নিয়মিত খেলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।
হাতিশুড় গাছের ঔষধিগুনগুলো পুরোপুরি মানব কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে যাচ্ছেন। এই গবেষণা লব্ধ ফলাফল গুলো পুরোপুরিভাবে প্রকাশ হলে মানব কল্যাণে আরও বেশি উপকারী হবে এই হাতিশুড় গাছের পাতা - শিকড়। এই আর্টিকেলটি পড়ে হাতিশুড় গাছ সম্পর্কে কিছু শেখার বা জানার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
aksgreenit নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url